প্রাইজবন্ডের
রেজাল্ট যেদিন বের হয় সিদ্দীক মিয়া সেদিন আগ্রহ নিয়ে পত্রিকা কিনেন। হুইল
চেয়ারে ভর করে রাস্তার মোড়ে হকারের জন্য অপেক্ষা করতে থাকেন। উনার মুখ চকচক
করে সেই সময়।
সিদ্দীক মিয়ার স্ত্রী জাহানারা বেগমের প্রত্যাশা দুইগুণ। স্বামীকে ঘুম থেকে জাগিয়ে চা-টা খাইয়ে ঠেলে পাঠিয়ে দেন পত্রিকা আনতে।
সিদ্দীক
মিয়ার তিন ছেলে-মেয়ে। এক ছেলে আর দুই মেয়ে। মেয়ে দুইজন বড়, আর ছেলে সবার
ছোট। মেয়ে দু’জন খুব শান্ত শীষ্ট। পড়াশুনাতেও ভালো। ছেলে বাউন্ডুলে। সবে
একাদশ শ্রেণীতে ভর্তি হয়েছে। বন্ধুদের সাথে আড্ডাতেই বেশি সময় দেয়।
প্রতিবারে
মত আজও পত্রিকা কিনতে বের হলেন সিদ্দীক মিয়া। হুইল চেয়ারে যেতে যেতে তিনি
তার অতীতের কথা ভাবেন। বাসের ড্রাইভার ছিলেন তিনি। তখন সংসারে কোনই অভাব
ছিল না। দারুন সুখেই দিন কাটছিল। কিন্ত এক ভয়াবহ সড়ক দূর্ঘটনায় সব তছনছ।
বাম পা কেটে বাদ দিতে হল সাথে সাথে। পরে ডান পাতে পচন ধরায় সেটাও বাদ দিতে
হয়। হুইল চেয়ারেই তার জীবন বেঁধে যায়। তার স্ত্রী দর্জির কাজ করে কোনমতে
সংসার ধরে রেখেছেন।
দূরে হকারকে দেখা যায়। কাছাকাছি আসতেই সিদ্দীক মিয়া চিৎকার করে ডাকলেন, “এই যে হকার ভাই”।
সাইকেল
থামিয়ে হকার দাঁড়ালেন। সিদ্দীক মিয়া দশ টাকার একটি নোট দিয়ে একটা প্রথমআলো
চাইলেন। হকার পত্রিকা দিয়ে টাকা পকেটে নিয়ে চলে যাচ্ছিলেন। সিদ্দীক মিয়া
গম্ভীর হয়ে বললেন, “এই যে ভাই, দুই টাকা ফিরত দিলেন না?”
হকার হাসি হাসি মুখে বললেন, “ভাই, পত্রিকা তো আট টাকা থেকে দশ টাকা হয়েছে! পত্রিকার উপরে মূল্য দশ টকা লেখা আছে দেখেন।”
সিদ্দীক মিয়া বিমর্ষ হয়ে মূল্য দশ টাকা লেখা দেখলেন আর বলেন, “ও আচ্ছা, ঠিক আছে, যান।”
তিনি হুইল চেয়ার ঘুরিয়ে দ্রুত বাড়ি ফিরে এলেন। বাড়িতে প্রবেশ করেই ক্ষীরের ঘ্রাণ পেলেন। ততক্ষণে তার মাথা থেকে দুই টাকা চলে গেছে।
জাহানারা বেগম ক্ষীর নাড়তে নাড়তে বললেন,“ না, আগেই পত্রিকা খুলবেন না। আগে মিষ্টি মুখ হবে তারপর সবাই মিলে ড্র দেখা হবে।”
সিদ্দীক
মিয়া মুচকি হেসে বললেন,“ তোমার ছেলে মানুষী স্বভাব আর গেল না। তাছাড়া
আমাদের পোড়া কপাল, আমরা কি আর জিততে পারবো প্রাইজ। প্রাইজবন্ড সব ভাঙিয়ে
ফেল।”
জাহানারা বেগম নরম গলায় বললেন, “ দেখবেন লিটনের বাবা, আমরা ১ম প্রাইজ পাবোই।”
সিদ্দীক মিয়া আক্ষেপ নিয়ে বললেন, “ নাহ, সেটা মনে হয় আমি বেঁচে থাকতে হবে না।”
জাহানারা বেগম এবার প্রায় কেঁদেই ফেললেন। কান্না জড়িয়ে বললেন, “ এসব অলক্ষণে কথা কেনো যে বলেন!”
সিদ্দীক মিয়া প্রসঙ্গ পাল্টে বললেন, “ কই, ক্ষুধায় তো পেট জ্বলছে, তোমার স্প্যাশাল ক্ষীর খেতে দাও।”
আচঁলে চোখ মুছতে মুছতে জাহানারা বেগম বললেন, “ আপনে ছেলে-মেয়েদের ডাকেন, আমি দিচ্ছি।”
রুনু ঝুনু পাশের ঘরেই পড়ছিল। মায়ের কথা শুনেই তারা হাজির। “ আমাদের ডাকতে হবে না বাবা, আমরা এসে পড়েছি।”
সিদ্দীক মিয়া বললেন, “ ভালো হয়েছে। যা তো ঝুনু মা লিটনকে ডেকে নিয়ে আয়।”
ঝুনু লিটনকে ডাকতে গেল। রুমের দরজায় কড়া নেড়ে ডাকলো, “এই ভাই, উঠ। অনেক তো বেলা হলো, আর কত ঘুমাবি।”
ঘর থেকে আওয়াজ আসে, “ঝুনু আপা তোমার আমার ঘুমের উপর এতো রাগ কেন? যাও তো, ঘুমাতে দাও।”
ঝুনু শান্ত গলায় বলল, “ভাই, না উঠলে ক্ষীর মিস।”
লিটনের ক্ষীর খুব প্রিয়, তাই আর কথা বাড়ানো লাগলো না। নি:শব্দে বিছানা থেকে উঠে কল ঘরে চলে গেল।
লিটন হাত মুখ ধুয়ে এলে সবাই একসাথে খাওয়া শুরু করল। লিটন চুপচাপ খেয়ে নিল ক্ষীর।
খাওয়া শেষ
হলে সিদ্দীক মিয়া ঝুনুকে বললেন, “ যা তো ঝুনু মা ঘরে টেবিলের নিচে একটা
কাগজে প্রাইজবন্ডের নম্বরগুলো লেখা আছে। সেটা তাড়াতাড়ি নিয়ে আয়। তোদের মা
বুঝি এবার লাখপতি হয়েই গেল।”
একটা হাসির রোল পড়ে গেল সিদ্দীক মিয়ার নরম রসিকতাই।
কাগজটি দেখে তিনি মিলাতে লাগলেন, “০০৯২৩, ইস, আর দুইটা নম্বরের জন্য হাতছাড়া হয়ে গেল। না, লিটনের মা, এবারও হলো না।”
সবাই বিষন্নমুখে যার যার কাজে চলে গেল।
২.
বিকালে বারান্দায় বসে সিদ্দীক মিয়া পত্রিকা পড়ছিলেন। আবুল কালাম হাজি সাহেব বাড়িতে ঢুকলেন।
“সিদ্দীক মিয়া, ও সিদ্দীক মিয়া।”
“আরে হাজি সাহেব যে, আসসালামু আলাইকুম।”
“ওয়া আলাইকুম আসসালাম।”
“বসেন হাজি সাহেব।”
“ না মিয়া, বসতে পারবো না। ঘটনা হলো কাল আমার ছেলে রনির জন্মদিন। একটা ছোট্ট আয়োজন করেছি। তুমি অবশ্যই আসবা কিন্তু।
“ ও, আচ্ছা। অবশ্যই।”
“ হ্যাঁ, মনে থাকে যেন, আগামীকাল দুপুরে। আমি এখন যাই, আরও কয়েকজনের বাসায় যাওয়ার আছে।”
অবশ্যই
যাবেন বলে সিদ্দীক মিয়া চিন্তায় পড়ে গেলেন। খালি হাতে প্রাইজ ছাড়া তো আর
যাওয়া যায় না। হাতে নগদ টাকাও নেই। তাহলে কি নিয়ে যাবেন। হ্যাঁ, একটা জিনিস
আছে প্রাইজবন্ড। একটা প্রাইজবন্ড নিয়ে যাবেন ভেবে মন শান্ত করলেন। উনার
স্ত্রীও রাজি হলেন।
পরেরদিন
দুপুরে ছোট মেয়ে ঝুনুকে নিয়ে সিদ্দীক মিয়া জন্মদিনের দাওয়াতে গেলেন। বাড়ির
উঠানে প্যান্ডেল সাজিয়ে এক হুলুস্থুল অবস্থা। যেন রাজকীয় বিয়ে হচ্ছে। তিনি
লজ্জিতহ মুখে রনির হাতে প্রাইজবন্ডটি গুঁজে দিলেন। খেতে বসে তিন প্লেট
পোলাও মাংস খেয়ে ফেললেন। খাওয়ার পর ধই দেওয়া হল। ঝুনু আবার ধই খায় না,
কাজেই উনাকে দুইজনেরটাই খেতে হলো। আসার পথে সাজিয়ে রাখা পানের থালা থেকে
একটি পান মুখে দিলেন।
পিচ করে
পানের পিচকি ফেলে তিনি বললেন, “বুঝলিরে ঝুনু মা, হাজি সাহেব বিরাট
দিলদরিয়া। মানুষ তো বিয়ের আয়োজনও এমন বিরাট করে না। বললেন ছোট আয়োজন, অথচ
দেখ কি কান্ড!”
হিজাব ঠিক করতে করতে ঝুনু বলল, “হ্যাঁ বাবা, তবে আফসোস।”
“ কেন আফসোস? কমতি কই দেখলি?”
“না মানে, আপারে নিয়ে আসলে ভালো হতো।”
“ও..., দেখিস মা, তোদের বিয়ে আমি ধুমধাম করে দিব। তখন একজন আরেকজনের বিয়ে খাবি।”
ঝুনু কিছু বললো না, শুধু মুচকি মুচকি হাসলো।
৩.
এরপর
তিনমাস কেটে গেল। প্রাইজবন্ডের ড্র হলো। এবার আর সিদ্দীক মিয়ার কোন আগ্রই
নাই। বিকালে ফটোকপির দুকানে গিয়ে ড্রয়ের ফলাফল কপি করে আনবেন ভাবলেন।
বিকাল বেলা তাই করলেন, কপি করে এনে প্রাইজবন্ড মিলাতে বসলেন একাএকা। ভাবলেশহীন মন। আগ্রহ মরে গেছে।
তাঁর স্ত্রী ঘরে ঢুকে বললেন, “কি অবস্থা?”
তিনি কোন
কথা বললেন না। হঠাৎ চোখ চকচক করতে লাগলো। জোরে জোরে বলতে লাগলেন ,
“০২৭৭৫৫৬”! হাসতে গিয়েও হাসতে পারলেন না। দৌঁড়ে গিয়ে ড্রয়ার খুলে বারবার
প্রাইজবন্ডটি খুঁজলেন। নাহ, যেটা মিলেছে সেটা নেই, বাকি সবগুলোই আছে। তিন
মাস আগে হাজি সাহেবের ছেলের জন্মদিনে যেটা দেওয়া হয়েছিল সেটাই মিলেছে।
জাহানারা
বেগম অজ্ঞান হয়ে গেলেন। সিদ্দীক মিয়া হায় হায় করতে লাগলেন। এখন কি করবেন।
রুনু ঝুনু বাবার হাকডাক শুনে দৌঁড়ে আসলো। “কি হয়েছে বাবা? মা’র কি হয়েছে?”
“তাড়াতাড়ি বালতিতে পানি এনে মাথায় ঢাল।”
আসল কথা
মেয়েদের জানালেন না। জাহানারা বেগমও সুস্থ হয়ে চুপচাপ হয়ে রইলেন। কারও সাথে
কথা বললেন না। লিটন এই প্রথম বাড়িতে এসে কোন ধমক খেল না। ব্যাপারটা তার
বেশ ভালোয় লাগলো। সে নিজেই চুপচাপ খেয়ে ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়লো। কি দরকার
ঝামেলা বাড়িয়ে!
সিদ্দীক মিয়া রাতে ঘুমাতে পারলেন না। হুইল চেয়ারে বসেই রাত পাড় করে দিলেন।
সকালে ১০
টার পর তিনি হাজি সাহেবের বাড়িতে গেলেন। এই সময় হাজি সাহেব কাজে চলে যান।
তাঁর স্ত্রী শিরীন সুলতানা বাসায় থাকেন। তিনি সরল সোজা মহিলা।
সিদ্দীক মিয়া গলার স্বর করুন করে বললেন, “ভাবি, একটা বিপদে যে পড়েছি।”
শিরীন সুলতানা অবাক হয়ে বললেন, “কিসের বিপদ? টাকা ধার-টার লাগবে নাকি?”
“না, না, ভাবি, টাকা তো না। আসলে একজন আমার কাছে প্রাইজবন্ড রাখতে দিয়েছিল। এখন সে আবার ফেরত চাচ্ছে।”
“ তা আমি কি করবো! ফেরত চাচ্ছে দিয়ে দেন, ঝামেলা শেষ!”
“ ভাবি, তার মধ্যে একটা তো রনির জন্মদিনের সময় রনিকে দিয়েছিলাম। তখন হাতে টাকা পয়সা কিছুই ছিল না। তাই অনেকটা বাধ্য হয়েই দিয়েছিলাম।”
“ও, এই ব্যাপার, এটা কোন বিপদই না! ভাই একটু বসেন, আমি ভিতর থেকে আসছি।”
এই বলে
শিরীন সুলতানা ভিতরের ঘরে চলে গেলেন। সিদ্দীক মিয়া ঝিম ধরে হুইল চেয়ারে বসে
আছেন। তার বুকের ভিতরে ধুক ধুক করা বেড়ে চলেছে। অস্থিরতাও বেড়ে যাচ্ছে।
উল্টা পাল্টা কথা মনে এসে পড়ছে, এই বুঝি শিরীন ভাবি বটি নিয়ে দৌড়ে আসছেন।
অগ্নিমূর্তী রূপ উনার। মনকে স্থীর করার জন্য রুনু ঝুনুর বিয়ে দেওয়ার কথা
ভাবতে লাগলেন। এতে কোন লাভ হলো না। মাথা থেকে বটি যাচ্ছে না।
শিরীন সুলতানা কিছুক্ষণ পর ফিরে এলেন। উনার হাতে পেচানো প্রাইজবন্ড। “এই নিন ভাই।”
সিদ্দীক
মিয়া যতটা সম্ভব স্বাভাবিক হয়ে প্রাইজবন্ডটা নিলেন। পেচানোটা ছাড়িয়ে
নম্বরটি দেখে নিশ্চিত হলেন। “বাঁচালেন ভাবি। এই নিন এই টাকাটা রাখুন, রনিকে
কিছু কিনে দিয়েন।”
“আরে ভাই, থাক, থাকতো, লাগবে না।”
“না ভাবি, তাই হয় না। রাখেন তো!”
শিরীন সুলতানা ইতস্তত করে টাকাটা নিলেন।
“আচ্ছা ভাবী এখন আসি, ভালো থাকবেন।”
শিরীন সুলতানা জবাব দেওয়ার ফুরসত পেলেন না। রনির কান্না শুনে দৌঁড়ে ভিতরে চলে গেলেন।
সিদ্দীক মিয়া বুক পকেটে প্রাইজবন্ডটি ভাঁজ করে রেখে হুইল চেয়ার ঘুরিয়ে নিলেন। সামনে তার স্বপ্নের ভবিষ্যৎ অপেক্ষা করছে। #
valo laglo.egiye jau.
উত্তরমুছুন